বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি একটি ভারসাম্যপূর্ণ, বাস্তবমুখী এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এই মূলনীতিকে ধারণ করেছে। এই নীতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণয়ন করেন, যা আজও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থানকে শান্তিপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক রাখতে চেয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক উন্নয়ন। ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি বাংলাদেশ সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত, বাণিজ্য, পানি বণ্টন এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কও বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের পর থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করছে।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক কূটনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC), বিমসটেক (BIMSTEC), এবং এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য সংস্থার (APTA) মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা দেখা যায়। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (OIC) এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন মুসলিম দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমবাজার এবং রেমিট্যান্সের বিষয়েও গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মিয়ানমার থেকে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের আশ্রয়ে রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবে এই সংকটের সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা করে আসছে, এবং এই ইস্যুতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
সবশেষে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি শান্তিপূর্ণ, সহযোগিতামূলক এবং বহুমুখী সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে। বাংলাদেশ তার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিকে স্থিতিশীল রেখে কৌশলগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।