জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-Aligned Movement বা NAM) হলো এক ধরনের কূটনৈতিক জোট যা শীতল যুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন পূর্বাঞ্চলীয় জোটের বাইরে থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজস্ব অবস্থান গড়ে তুলতে চেয়েছিল, যা অনেকাংশেই জোট নিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। এই নিবন্ধে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততা এবং এর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পটভূমি ও উদ্দেশ্য:
১৯৬১ সালে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেডে প্রথম জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যার নেতৃত্ব দেন তৎকালীন নেতা তিতো, নেহরু, এবং নাসের। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং শীতল যুদ্ধের ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে না গিয়ে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করা। NAM এর সদস্য দেশগুলো ছিল প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশ, যাদের উন্নয়ন এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশের সংযুক্তি:
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন এবং জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে, যা NAM এর মূল নীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কোনো সামরিক জোটে যুক্ত হওয়া নয়, বরং নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করা উচিত, যাতে বৈশ্বিক শান্তি, সংহতি এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করা যায়।
বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত NAM সম্মেলনে প্রথমবারের মতো যোগদান করে। এর মাধ্যমে দেশটি প্রথমবারের মতো বিশ্ব মঞ্চে নিজের পরিচয় তুলে ধরার সুযোগ পায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাংলাদেশকে শান্তির পক্ষে, ন্যায়বিচারের পক্ষে এবং উপনিবেশবাদ বিরোধী আন্দোলনের এক অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের অন্যান্য নেতারাও NAM সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
NAM-এ বাংলাদেশের অবদান:
১. শান্তি ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি: বাংলাদেশ সবসময়ই শান্তি এবং উন্নয়নের পক্ষপাতী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে। NAM এর সদস্য হিসেবে, বাংলাদেশ অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং সামরিক জোটবদ্ধতা এড়িয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার চেষ্টা করেছে।
২. উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান: NAM এর নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশও সবসময় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির পক্ষপাতী ছিল। বাংলাদেশ তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে অন্যান্য স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য সমর্থন দিয়েছে।
৩. আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা: NAM এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষা খাতে।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট:
শীতল যুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বব্যাপী জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের তাৎপর্য কিছুটা কমে গেলেও, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে NAM এর নীতিগুলোকে সম্মান করে আসছে। বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে NAM এর আদর্শকে অনুসরণ করে চলেছে। বর্তমানেও বাংলাদেশ NAM এর সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং বৈশ্বিক সমস্যাগুলোতে একটি নিরপেক্ষ এবং সমাধানমুখী দৃষ্টিভঙ্গি রাখার চেষ্টা করে।
উপসংহার:
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম, যা বৈশ্বিক শান্তি, ন্যায়বিচার, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে NAM এর আদর্শ এবং নীতিগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছে এবং দেশটির আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। সামগ্রিকভাবে, NAM-এর সাথে বাংলাদেশের জড়িত থাকার মধ্য দিয়ে দেশের শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ এবং উন্নয়নমুখী ভাবমূর্তি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।