স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে তৃতীয় বিশ্বের মিত্রদের প্রতি মার্কিন আসরণ কী রকম হবে? এসব দেশের শাসকবর্গ কি বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতা বােধ করছে?

স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) পরিসমাপ্তি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে ঘটে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একক বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বিশ্বের মিত্রদের প্রতি আচরণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়:

  1. জিওপলিটিকাল প্রাধান্য: স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সোভিয়েত প্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্য মিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। সোভিয়েত ব্লকের পতনের পরে, এই দেশগুলোর কৌশলগত মূল্য কিছুটা কমে যায়, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলোর ওপর প্রভাব ধরে রাখার জন্য বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখে।
  2. গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসার: স্নায়ুযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষেত্রে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক উদারীকরণের উপর আরও বেশি জোর দেয়। মার্কিন নীতি তখন থেকে এই দেশগুলোর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে সমর্থন করার নামে গণতন্ত্র প্রচারের প্রচেষ্টায় মনোযোগী হয়।
  3. অর্থনৈতিক সহযোগিতা: স্নায়ুযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের বাজারকে খুলে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের ওপর তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করে।
  4. সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা: ৯/১১ হামলার পর, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের মিত্র দেশগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেয়। বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ মোকাবিলায় মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

তৃতীয় বিশ্বের শাসকবর্গের নিরাপত্তাহীনতা

স্নায়ুযুদ্ধের পরে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের শাসকরা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন। এর কিছু কারণ হলো:

  1. মার্কিন সমর্থনের অভাব: স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক স্বৈরশাসক বা একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পেছনে সমর্থন দিয়েছিল, যাতে তারা কমিউনিস্ট বিপ্লব বা সোভিয়েত প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের সরাসরি সমর্থন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, যা অনেক শাসককে রাজনৈতিকভাবে একা করে তোলে।
  2. গণতন্ত্র প্রচার নীতি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের পর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রচারে গুরুত্ব দেয়, যা তৃতীয় বিশ্বের অনেক একনায়কতান্ত্রিক শাসককে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে। তারা আশঙ্কা করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরোধিতা করবে বা তাদের ক্ষমতা দুর্বল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।
  3. অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা: তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা বিদ্যমান, যা শাসকগোষ্ঠীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের ফলে এই শাসকরা নিজেদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতা ধরে রাখতে সমস্যা অনুভব করতে পারে।
  4. বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ: অনেক তৃতীয় বিশ্বের শাসক মনে করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে, বিশেষ করে যদি তাদের শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্র বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। এই ধরনের হস্তক্ষেপের ভয় অনেক শাসকের জন্য নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারে।

সারসংক্ষেপ

স্নায়ুযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বের মিত্রদের প্রতি মার্কিন আচরণ পরিবর্তিত হয়েছে, যেখানে কৌশলগত মূল্যায়নের পরিবর্তে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উদারীকরণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক শাসক নিজেদের অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন, বিশেষ করে মার্কিন সমর্থনের অভাব এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার কারণে।

Leave a Comment